প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার কারণেই গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দ্বিতীয় দফায় বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে ভারতের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি নিবন্ধে। বৃহস্পতিবার পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে এর 'টিওআই কন্ট্রিবিউটর' রাশিদুল বারি 'দ্য নেভার-এন্ডিং ট্রায়াল অব মুহাম্মদ ইউনূস' নামে এ নিবন্ধটি লিখেছেন।
এতে ইউনূসের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নেতিবাচক আচরণের তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। নিবন্ধে বলা হয়, "মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের পর থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি নোবেল পুরস্কার, মার্কিন প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল, মার্কিন কংগ্রেসনাল মেডেলের মতো 'ট্রিফেক্টা' (তিনটি পুরস্কার) লাভ করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ঠিকই দ্বিতীয়বারের মতো বিচারের মুখোমুখি করাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, ড. ইউনূস সরকারের যথাযথ অনুমতি ছাড়া তিনি বিভিন্ন আয় করেছেন। এর মধ্যে নোবেল পুরস্কার এবং তার বই বিক্রি করে উপার্জিত আয়ও রয়েছে। কিন্তু নতুন করে এ বিচারের কথা শুনে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ। এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৩ লাখ দরিদ্র নারী থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও রয়েছেন। এ অবস্থায় প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে কে সঠিক। ড. ইউনূসের নিজ দেশের নেতা সঠিক, নাকি যিনি মুক্ত পৃথিবীর নেতা তিনি সঠিক? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রথম বিচারের বিষয়টির দিকে তাকাতে হবে।"
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রথম বিচার শুরু করেছিলেন ২০১০ সালে। যখন ওই বছরের ৩০ নভেম্বর নরওয়ের টেলিভিশন সে দেশের টম হেনিম্যান নামে এক ব্যক্তির তৈরি ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করেছিল। এর এক মাস পরই শেখ হাসিনা ড. ইউনূসকে বিচারের মুখোমুখি করান। ওই প্রামাণ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছিল, ড. ইউনূস ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে স্থানান্তর করেছিলেন। শেখ হাসিনা এ অস্ত্রটিই ইউনূসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন এবং তিনি তাকে 'রক্তচোষা' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এরপর শেখ হাসিনা তাকে চাকরিবিধি অনুযায়ী ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক বলে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুত করেন। এর পর থেকে অনেকেই ভেবেছিলেন হয়তো ইউনূসের বিরুদ্ধে অ্যাকশন এখানেই শেষ। কিন্তু শেখ হাসিনা গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধেও তার আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। তিনি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ওপরও চাপ অব্যাহত রাখেন এবং এর ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা চালিয়ে আসেন আর ব্যাংকটি ভেঙে ১৯ টুকরা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ বছরের সেপ্টেম্বরে এসে দেখা গেল শেখ হাসিনার মিশন স্বয়ং ইউনূসকেই ধ্বংস করা। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ইউনূসকে আবারো বিচারের মুখোমুখি করার।
ড. ইউনূসও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ চ্যালেঞ্জ করেন এবং দাবি করেন, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন, রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ওবামা প্রশাসনও প্রধানমন্ত্রীকে ইউনূসের ব্যাপারে ন্যায় ও স্বচ্ছ আচরণের আহ্বান জানান।''
এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার মধ্য দিয়ে সেই বিখ্যাত আর্কিমিডিস-জেনারেল মারসিলাস দ্বন্দ্বই আধুনিক যুগে উপস্থাপিত হলো। রোমান সৈনিকরা গণিতবিদ আর্কিমিডিসকে হত্যা করেছিল। কারণ তার অপরাধ ছিল, তিনি জেনারেল মারসিলাসের সঙ্গে বৈঠক করতে অস্বীকার জানিয়েছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন, 'আমার সার্কেলের (বৃত্ত) ক্ষতি করো না। একই প্রতিক্রিয়াশীল চেতনা কাজ করছে ইউনূসের বেলায়।”
লেখক রাশিদুল বারি প্রশ্ন তোলেন, “রোমান সৈনিকরা গণিতের জনককে হত্যা করেছিল, কারণ তারা মূর্খ ছিল। তারা ভেবেছিল, একটি জ্যামিতির সমস্যার সমাধানের চেয়ে জেনারেল মারসিলাসের সঙ্গে বৈঠক করাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আচরণ কি সেই অজ্ঞতারই প্রতিচ্ছবি? মূলত তিনটি ঘটনা শেখ হাসিনাকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছে। আর তা হলো নোবেল পুরস্কার, হিংসা ও রাজনীতি।”
রাশিদুল বারির মতে, “প্রথমবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পুরস্কার বিজয়কে মেনে নিতে পারেননি শেখ হাসিনা। কারণ তার ধারণা ছিল, নরওয়েজিয়ান নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি তাকেই এ পুরস্কার দেবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি পুরস্কার পাওয়ার জন্যই তিনি এমনটা আশা করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনার হিংসা। কারণ ইউনূস ক্রমেই বিখ্যাত এবং অনেক পুরস্কার অর্জন করতে থাকেন। হাসিনার ভয়, ইউনূসের এই খ্যাতি তার বাবা শেখ মুজিবকে ছাড়িয়ে যাবে। তৃতীয়ত, রাজনীতিতে ইউনূসের যোগদানের চেষ্টা।”
ড. ইউনূস স্বর্গর্ থেকে আসা কোনো ব্যক্তি নন এবং তিনি ভুলেরও ঊর্ধ্বে নন মন্তব্য করে লেখক রাশিদুল বারি বলেন, “আমি সঠিক জানি না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে এই বিচার বন্ধ করবেন। তবে আমি এই আশা করতে পারি যে তিনি কখনোই তার সৈন্যদের আর লেলিয়ে দেবেন না, মারসিলাস যেভাবে আর্কিমিডিসের পেছনে সৈন্যদের লেলিয়ে দিয়েছিলেন।”
সূত্র: কালের কণ্ঠ।
The Daily Online Post
No comments:
Post a Comment
Thank You for your Participation